আপনি মানেন আর না মানেন, এটা সত্যি যে, ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড (Credit Card) অনেকের জীবনেই ধ্বংস ডেকে এনেছে। ক্রেডিট কার্ডের উচ্চ সুদের ভয়ঙ্কর ঋণের ফাঁদে পড়ে অনেকের জীবনেরই আজ ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এর অন্যতম একটি কারণ, ক্রেডিট কার্ডের সুদ হিসাবের ভয়ঙ্কর পদ্ধতি। অনেকেই জানেন না, ব্যাংক গুলোতে ঠিক কি পদ্ধতিতে ক্রেডিট কার্ডের সুদ হিসাব করা হয়? আবার ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা ও অসুবিধা গুলো আসলে কি, সেটাও অনেকে জানে না। অথচ একটু বুদ্ধি খাটিয়ে স্মার্টলি ব্যবহার করতে পারলেই কিন্তু Credit Card থেকে অনেক সুবিধা নেয়া যায়।
যাইহোক, ক্রেডিট কার্ড আসলে কি এবং Credit Card ব্যবহার করতে গিয়ে কেন এবং কিভাবে মানুষ চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের গ্যাড়াকলে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে পড়ে, সেইসব রহস্যই ভেদ করার চেষ্টা করেছি আজকের এই পোস্টে।
Credit Card স্মার্টলি ব্যবহার করার জন্য এর সাথে সম্পর্কিত সকল তথ্য সঠিক ভাবে জানা প্রয়োজন। বিশেষ করে বিভিন্ন Bank- এর ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার এবং নানা ধরনের চার্জ গুলো সম্পর্কে না জানলে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। কেননা এই তথ্যগুলো না জানা কিংবা গুরুত্ব না দেয়ার কারণেই ক্রেডিট কার্ড মানুষের পকেটের বারোটা বাজিয়ে দেয়।
অন্যদিকে এসব তথ্য যদি ঠিকমত জানা থাকে তাহলে খুব সহজেই Credit Card থেকে সর্বাধিক সুবিধা নেয়া যায়। স্মার্টলি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারলে আপনি এর সর্বোচ্চ সদ্বব্যবহার করে বেশি বেশি সুবিধা নিতে পারবেন এবং সেইসাথে নিজেকে এই সব বিপদ থেকে দূরেও রাখতে পারবেন।
এসব বিষয় নিয়েই এই আলোচনা করা হয়েছে এই পোস্টে। পোস্টটি শেষ পর্যন্ত পড়লে আপনি জানবেন, ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার আসলে কতটা ভয়ংকর হতে পারে। আর এই ভয়ঙ্কর সুদ চক্র থেকে বের হওয়ার সঠিক উপায়।
ক্রেডিট কার্ড একটি ঋণ প্রোডাক্ট
ক্রেডিট কার্ড নিয়ে বিপদে পড়ার সবচেয়ে বড় কারণটি হল এর সুদ এবং চার্জ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকা।
ক্রেডিট কার্ড যেহেতু একটি ঋণ নেয়ার হাতিয়ার তাই এরসাথে সুদ এবং নানা রকম চার্জ যুক্ত থাকে। এরমধ্যে রয়েছে ইয়ারলি রিনিউয়াল চার্জ, ওভার লিমিট চার্জ, লেট পেমেন্ট চার্জ, ক্যাশ উইথড্রয়াল চার্জ ইত্যাদি।
তো আসুন প্রথমেই জেনে নেই ক্রেডিট কার্ডের সুদ কিভাবে আপনাকে ধ্বংস করে সে সম্পর্কে।
ক্রেডিট কার্ড আপনার জীবনে বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে যদি আপনি এর সুদ কিভাবে নির্ধারণ করা হয় সে সম্পর্কে না জানেন।
মনে রাখবেন, ব্যাংকের যত ঋণ প্রোডাক্ট আছে, তারমধ্যে ক্রেডিট কার্ডের ঋণের সুদের হার সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে এটা আগে ২৩ থেকে ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত হত, কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক সব ধরনের ক্রেডিট কার্ডের সর্বোচ্চ সুদের হার ২০ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে। যা এখনও অবিশ্বাস্য রকমের বেশি।
যাইহোক, আপনি যদি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী হন বা করতে চান, তাহলে শুরুতেই আপনাকে জানতে হবে, আপনি যে কার্ডটি ব্যবহার করছেন বা করবেন, এর সুদের হার কত?
হিসাবের সুবিধার্তে ধরে নিলাম আপনার কার্ডের সুদের হার ৩০ শতাংশ। এখন দেখুন এই হার কিভাবে আপনাকে ঋণের সাগরে হাবু-ডুবু খাওয়ায়!
ক্রেডিট কার্ড যেভাবে আপনাকে আর্থিকভাবে ডুবিয়ে ছাড়ে
কার্ডের সুদের হার ৩০ শতাংশ হলে, আপনি যদি ক্রেডিট কার্ড থেকে মাত্র ১ হাজার টাকা ঋণ নেন, তাহলে প্রতিদিন সুদ বাবাদ আপানাকে দিতে হবে কমবেশি মাত্র ৮৩ পয়সা (হ্যা, টাকা নয়, পয়সা)!
কি খুব কম মনে হচ্ছে? তাহলে এবার দেখুন এখানে শুভঙ্করের ফাঁকিটি আসলে কথায়!
দৈনিক মাত্র ৮৩ পয়সা সুদ আসলেও আপনি কিন্তু প্রতিদিন সেই টাকা পরিশোধ করছেন না। আপনি পরিশোধ করছেন মাসের শেষে যখন আপনার সুদ গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ২৫ টাকায়। এখনো কম মনে হচ্ছে? তাহলে পড়তে থাকুন।
এখন কথা হচ্ছে, আপনি মাসে নিশ্চয় মাত্র ১ হাজার টাকা খরচ করে বসে থাকবেন না। ধরে নিলাম, আপনি হয়ত প্রতিমাসে গড়ে ৩০ হাজার টাকা খরচ করেন।
যদি তাই হয়, তাহলে ৩০ হাজার টাকার জন্য মাসে আপনাকে শুধু সুদ বাবদ দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত ৭৫০ টাকা।
এখন আপনি যদি প্রথম মাস শেষে ৭৫০ টাকা সুদ সহ আসল ৩০ হাজার টাকা পরিশোধ করে দেন, তাহলে সব ঠিক আছে। আপনার দায় এখানেই শেষ।
কিন্তু আপনি যদি কোন কারণে মাস শেষে পুরোটা শোধ না করেন, তাহলে সেই ৭৫০ টাকা আবার আপনার আগের বাকি টাকার সাথে যোগ হয়ে যাবে এবং তখন সেই পুরো টাকার উপর আবার নতুন করে হাজারে ৮৩ পয়সা হিসেবে প্রতিদিন সুদ যোগ হতে থাকবে।
এখানেই শেষ নয়, কেননা এর সাথে আবার আপনার চলতি মাসের খরচের অংকও যোগ হতে থাকবে। এভাবে দেখা যায় চোখের নিমিষেই সুদ সহ মোট টাকার পরিমাণ আপনার পরিশোধের সামর্থের বাইরে চলে যায়।
আর আপনাকে এই ঋণের জালে ফেলার জন্য ক্রেডিট কার্ড কোম্পানিগুলো নানা রকম লোভনীয় ফাঁদ তৈরি করে রেখেছে, এবং তাতে আপনি ঠিকমত না বুঝেই পা দিয়ে ফেলছেন!
তো কি সেই ফাঁদ?
সাধারণত ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি গুলো প্রতিমাসে আপনি যে টাকা খরচ করেন সেটা পরিশোধের জন্য বেশ কয়েকদিনের বাড়তি সুদমুক্ত সময় দিয়ে থাকে। এই সুদ মুক্ত পরিশোধের সময়সীমা ব্যাংক ভেদে সাধারণত ১৫ থেকে ২০ দিন হয়।
অর্থাৎ আপনার কার্ডের স্টেটমেন্ট যদি মাসের ১ তারিখে জেনারেট হয়, তাহলে আপনি ঐ মাসের ১৬ তারিখ পর্যন্ত সময় পাবেন সুদ ছাড়া পুরো অর্থ পরিশোধের জন্য। আপনি যদি এই সময়ের মধ্যেই সমস্ত দায় শোধ করে দেন, তাহলে আপনাকে কোন ঝামেলায় পড়তে হবে না।
কিন্তু আপনার মত বেশিরভাগ মানুষই সেটা করে না। এজন্য তারা ব্যাংকের আরেকটি লোভনীয় ফাঁদ বেছে নেয়, যা আপনার মত লোকের জন্যই ব্যাংক গুলো তৈরি করে রেখেছে।
পুরো অর্থ পরিশোধের বদলে ব্যাংক মাত্র ৫ শতাংশ দায় পরিশোধের সুযোগ দেয়, যাতে ব্যবহারকারি তার কার্ডটি চালু রাখতে পারেন।
কিন্তু স্টেটমেন্টের পুরো অর্থ পরিশোধ না করার জন্য ব্যাংক আর পরবর্তী মাসে গ্রাহককে কোন ইন্টারেস্ট ফ্রি বা সুদ মুক্ত সময়সীমা দেয় না, ফলে প্রতিদিন সুদের টাকা জমা হতে থাকে।
এখন ধরুন, আপনার সেই প্রথম মাসের ৩০ হাজার টাকা আপনি পুরপুরি শোধ না করে মাত্র ৫ শতাংশ বা ১৫০০ টাকা পরিশোধ করলেন। আর এতে করে যা হল, তা হয়ত আপনার চিন্তারও বাইরে!
মাত্র ১৫০০ টাকা পরিশোধের পর আপনার বাকি থাকল ২৮ হাজার ৫০০ টাকা। যার জন্য চলতি মাস শেষে আপনাকে সুদ দিতে হবে প্রায় ৭১০ টাকা (৩০ শতাংশ হারে হিসাব করলে)। তো আপনার মোট দায় দাঁড়াল ২৯ হাজার ২১০ টাকা।
এর বাইরে আবার আপনার চলতি মাসের খরচ ধরে নিলাম আরও ৩০ হাজার টাকা। এই টাকার উপর যেহেতু আপনি কোন সুদমুক্ত সুবিধা আর পাবেন না, তাই এর উপরও প্রতিদিন সুদ জমা হতে থাকবে।
এটা একটি জটিল হিসাব, কেননা আপনি যেদিন যত টাকা আপনার কার্ড থেকে খরচ করবেন সেদিন থেকেই তত টাকার উপর সুদ জমতে থাকবে।
ধরে নিলাম আপনি মাসের প্রথমদিনই ৩০ হাজার টাকা খরচ করলেন। তাহলে এ মাসের শেষে নতুন করে খরচ করা ৩০ হাজারের জন্য আপনার সুদ হবে আরও ৭৫০ টাকা।
তাহলে দেখুন দ্বিতীয় মাস শেষে আপনার মোট দ্বায় গিয়ে দাঁড়াল ২৯২১০+৩০৭৫০ = ৫৯৯৬০ টাকা।
এখানেই শেষ নয়, আগের মাসে পুরো অর্থ শোধ না কারার জন্য এবার ব্যাংক আপনাকে ফিন্যান্স চার্জ বা লেট পেমেন্ট ফি আরোপ করবে, যার সাথে আবার ভ্যাটের টাকাও যোগ হবে।
ধরলাম ভ্যাট সহ আপনার লেট পেমেন্ট ফি আসল ২০৪০ টাকা। তাহলে দ্বিতীয় মাস শেষে আপনার চুড়ান্ত দায় দাঁড়াল ৬২ হাজার টাকা।
এখন ব্যাংক ভাল করেই জানে আপনি এই টাকা একসাথে শোধ করতে পারবেন না। কেননা মাত্র আগের মাসেই আপনি এর অর্ধেকেরও কম অর্থ পুরোপুরি পরিশোধ করতে পারেন নি!
তো আপনি এবার কি করবেন? হ্যা, আপনি আবারও মাত্র ৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধের সুযোগ নেবেন আর আপনার নিয়মিত খরচ চালিয়ে যাবেন। আর এভাবেই জমতে থাকবে আপনার ঋণের পাহাড়!
প্রতি মাসেই ৫ শতাংশ হারে শোধ করার পরও দেখবেন, আপনার ঋণের অংক তো কমছেই না, বরং লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে আপনার মিনিমাম পেমেন্ট হিসেবে ৫ শতাংশ হারে যে অংক একসময় ছিল সামান্য কিছু টাকা, সেটাও এখন বাড়তে বাড়তে একটা বড় অংকে রুপ নিয়েছে। প্রথম মাসে মাত্র ১৫০০ টাকা দিয়ে কার্ড চালু রাখতে পারলেও পরের মাস থেকে এই মিনিমাম পেমেন্টের অংকটাও ঊর্ধমূখি হতে থাকে।
এখানেই শেষ নয়!
আগেই বলেছিলাম, ক্রেডিট কার্ডের সাথে নানা রকম চার্জ যুক্ত আছে। আপনার ঋণের অংক যখন এভাবে প্রতিমাসেই বাড়তে থাকবে, তখন তা এক পর্যায়ে আপনার ক্রেডিট কার্ডের লিমিটকে ছাড়িয়ে যাবে। আর একবার যদি আপনার মোট ঋণ আপনার ক্রেডিট লিমিটকে অতিক্রম করে যায়, তাহলে ব্যাংক আপনাকে এবার ওভার লিমিট চার্জ করবে, যার সাথে আবার ভ্যাটের অংকও যোগ হবে।
আর লিমিট পেরিয়ে গেলে ব্যাংক আপনার কার্ডও বন্ধ করে দিবে। তখন একসঙ্গে আপনাকে অনেক টাকা পরিশোধ করতে হবে।
আশাকরি বুঝতে পারেছেন, কেন এবং কিভাবে আপনি ক্রেডিট কার্ডের ঋণের জালে আটকা পড়েছেন।
ক্রেডিট কার্ডের এই ভয়ঙ্কর ফাঁদ থেকে কিভাবে বাচবেন?
ক্রেডিট কার্ডের ঋণের ফাঁদ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে, সুদ মুক্ত সময়সীমার মধ্যেই কার্ডের সমস্ত দেনা পরিশোধ করে দেয়া।
এজন্য আপনাকে খরচের ব্যাপারে সাবধান হতে হবে। নিজের সাধ্যের বাইরে খরচ করবেন না।
আপনি যদি আবার কার্ড দিয়ে কেনাকাটা না করে সরাসরি ক্যাশ টাকা তোলেন, তাহলে আপনাকে কিন্তু আবার বেশ ভাল ভাবেই ভুগতে হবে। কেনানা, ক্যাশ তলার ক্ষেত্রে ব্যাংক গুলো কোন সুদ মুক্ত সময় সীমা দেয় না।
আপনি যেদিন ক্যাশ তুলবেন, সেদিন থেকেই সুদ যোগ হতে থাকবে। এর বাইরে আবার ক্যাশ তোলার জন্য আপনাকে ক্যাশ এডভান্স ফি চার্জ করা হবে।
সুতরাং, ক্রেডিট কার্ডের সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে হলে, কখনই ক্যাশ টাকা তুলবেন না, আর মাস শেষে স্টেটমেন্টের পুরো অর্থ পরিশোধ করে দেবেন।
এর বাইরে সময়ে সময়ে দেয়া ক্রেডিট কার্ডের নানা অফার নিতে ভুলবেন না। কিন্তু মনে রাখবেন, কোনভাবেই যেন ঠিক সময়ে পুরো টাকা পরিশোধে দেরি না হয়।
ক্রেডিট কার্ড নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন, সেটা আমাদের জানান কমেন্ট করে। আর এই পোস্টটি ভাল লাগলে অবশ্যই তা আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না।
সহজে পুরো বিষয়টি বোঝার জন্য নিচের ভিডিওটি দেখে নিতে পারেন।
ঠিক
উত্তরমুছুনআমি যদি বিকাশে কার্ড থেকে টাকা আনি, সেক্ষেত্রে এটার সুদ কি ক্যাশ টাকা উঠানোর মতো কাটবে নাকি কম সুদ কাটবে??
উত্তরমুছুনক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের অনেক সুবিধা আছে। পোস্টটি পড়ুন।
উত্তরমুছুন