চাকরিতে বেতনের বাইরে আরও যেসব আর্থিক সুবিধাদি থাকে, তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রভিডেন্ট ফান্ড (Provident Fund) এবং গ্রাচ্যুইটি (Gratuity)। কিন্তু এসব বিষয়ে অনেকেরই তেমন কোন সুস্পষ্ট ধারনা নেই।
অনেকেই জানেন না, প্রভিডেন্ট ফান্ড (PF) এবং গ্রাচ্যুইটি (Gratuity) আসলে কি? এগুলো কিভাবে কাজ করে আর এখান থেকে কি ধরেনর সুবিধা পাওয়া যায়?
প্রত্যেক চাকরিজীবীর জানা থাকা দরকার যে, কিভাবে প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং গ্রাচ্যুইটির হিসাব করা হয়?
কিন্তু বাস্তবতা হল, নিজ চাকরিতে এসব সুবিধা থাকার পরও অনেকই বিষয়গুলো ভাল করে বোঝেন না। অথচ একজন স্মার্ট ক্যারিয়ারিস্ট হিসেবে প্রত্যেকের উচিৎ চাকরি সংশ্লিষ্ট প্রতিটি সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে ভাল করে জানা।
আবার যারা চাকরিপ্রার্থী, তারাও এই বিষয় গুলো তেমন একটা বোঝে না।
বিভিন্ন চাকরির বিজ্ঞাপনে প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং গ্রাচ্যুইটি সুবিধার কথা লেখা দেখে অনেকেই কিছু না বুঝেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, যা অনেক সময়ই তাদের প্রত্যাশার সাথে মেলে না।
যেহেতু প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং গ্রাচ্যুটি হচ্ছে বেতনের বাইরে প্রাপ্ত আর্থিক সুবিধা, তাই এগুলো সম্পর্কে ভাল করে জানাটা জরুরী।
তাই এসব বিষয় নিয়েই আজকের আলোচনা। আশাকরি এই পোস্টটি পড়ার পর প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং গ্রাচ্যুইটি সম্পর্কে সবার একটি পরিষ্কার ধারনা তৈরি হবে।
প্রভিডেন্ট ফান্ড
এটি একটি কন্ট্রিবিউটরি বা অংশ গ্রহণ মূলক আর্থিক সুবিধা, যা ভালো যেকোন প্রতিষ্ঠানই তার কর্মীদের অফার করে থাকে।
আপনার প্রতিষ্ঠানে যদি প্রভিডেন্ট ফান্ড সুবিধা থাকে, তাহলে আপনি তাতে যোগ দিয়ে সেখান থেকে উপকৃত হতে পারেন।
প্রভিডেন্ট ফান্ডে যোগ দিতে হলে একজন কর্মীকে সাধারণত কমপক্ষে ৬ মাস ঐ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে হয়। তবে অনেক প্রতিষ্ঠানে যোগদানের শুরু থেকেই প্রভিডেন্ট ফান্ডে যুক্ত হওয়ার সুযোগ দেয়। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান কমপক্ষে ২ বছর চাকরি না করলে এই সুযোগ দেয় না।
এখন আপনি যদি আপনার প্রতিষ্ঠানের প্রভিডেন্ট ফান্ডে যোগ দেন, তাহলে প্রতিমাসে আপনার বেতন থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশ সেখানে জমা রাখতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এই জমার পরিমাণ হয় মূল বেতনের ১০ শতাংশ।
তবে প্রতিষ্ঠান ভেদে এর কম বেশি হতে পারে। যেমন কিছু প্রতিষ্ঠানে এই হার ৭ শতাংশ আবার কোথাও ১৫ শতাংশ!
আপনার জমার হার যাই হোক না কেন, এই টাকার মালিক আপনি, এবং এটা আপনারই থেকে যাবে। আইনে সেই সুরক্ষা দেয়া আছে।
এখানে জানার বিষয় হল, যেহেতু এটা একটা কন্ট্রিবিউটরি বা অংশিদারিত্বমূলক আর্থিক সুবিধা, তাই প্রতিমাসে আপনি যে পরিমাণ টাকা ফান্ডে জমা করবেন, আপনার চাকরিদাতাও একই পরিমাণ অর্থ প্রতিমাসে আপনার নামে সেই ফান্ডে জমা করবে।
অর্থাৎ আপনি যদি প্রতিমাসে ১ হাজার টাকা প্রভিডেন্ট ফান্ডে জমা রাখেন, তাহলে, আপনার চাকরিদাতাও আপনার নামে আরও ১ হাজার টাকা জমা করবে। তারমানে আপনার জমা করা অর্থ আসলে জমার সাথে সাথেই দ্বিগুণ হয়ে গেল!
এভাবে প্রতিষ্ঠানের সব কর্মী একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা করবে আর প্রতিষ্ঠানও একই পরিমাণ অর্থ দেবে। এতে করে খুব অল্প সময়েই বেশ বড় আকারের একটি ফান্ড দাঁড়িয়ে যায়।
কিন্তু এই ফান্ডের অর্থ কর্মীরা চাইলেই যখন তখন উঠিয়ে নিতে পারে না। কেননা পুরো ব্যাবস্থাটি একটি আইন দ্বারা পরিচালিত হয়।
প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ আরও বাড়ানোর জন্য সেই ফান্ড কোন ঝুকি বিহীন নিরাপদ খাতে বিনিয়োগ করা হয়। এতে করে ফান্ডের আকার আরও বড় হয়।
পুরো সিস্টেমটি এভাবেই চলতে থাকে আর এটি পরিচালনার জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড থাকে। এই ট্রাস্টি বোর্ড আবার গঠিত হয় প্রতিষ্ঠানের কর্মী এবং মালিক পক্ষের সমন্বয়ে। এরফলে উভয় দিক থেকেই প্রতিশ্রুত অর্থের যোগান এবং এর সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হয়।
তো এই ফান্ড থেকে কিভাবে একজন কর্মী উপকৃত হয়?
প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে উপকৃত হওয়ার দুটি উপায় আছে। মনে রাখবেন, এটি একটি কল্যাণ ফান্ড এবং এর মুল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ফান্ড সদস্যদের উপকার করা।
প্রভিডেন্ট ফান্ডের সবচেয়ে বড় প্রতিদান আপনি পাবেন, আপনার শেষ জীবনে অবসর নেয়ার সময়। সারা জীবন চাকরি করার পর, এই ফান্ড থেকে আপনি এককালীন অনেক বড় একটা অংকের অর্থ পাবেন যা আপনার অনেক উপকারে আসবে নিশ্চিতভাবেই।
আপনি একা সারা জীবন টাকা জমালে যত টাকা জমানো সম্ভব হত, প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে আপনি তার চেয়েও অনেক বেশি পরিমাণ অর্থ পাবেন। কেননা, এই ফান্ডে শুধু আপনার জমা করা টাকাই নয়, আপনার প্রতিষ্ঠানের দেয়া টাকা এবং বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত মুনাফার একটা অংশও আপনি পাবেন।
আবার অবসর নেয়ার আগে , অর্থাৎ চাকরি কালীন সময়েও আপনি এই ফান্ড থেকে উপকৃত হতে পারেন। আপনি চাইলে এই ফান্ডে আপনি যে পরিমাণ টাকা জমা করেছেন, তার একটা অংশ ঋণ হিসেবে নিতে পারেন।
যেহেতু নিজের রেখে দেয়া অর্থই আপনি ঋণ হিসেবে নিচ্ছেন, তাই এই ঋণের সুদের হার অত্যন্ত কম হয়। প্রতিমাসে ঋণের কিস্তি দেয়ার মাধ্যমে আপনি তা একসময় শোধ করতে পারবেন।
মনে রাখবেন, ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে আপনি শুধু নিজের জমা রাখা অংশের উপরই ঋণ পাবেন, আপনার পক্ষে প্রতিষ্ঠান যে অর্থ জমা করে সেটা এবং বিনিয়গের মুনাফার অংশ থেকে আপনি ঋণ পাবেন না।
আর ঋণের কিস্তি চলার সময়ও আপনাকে নিয়মিত ভাবে প্রভিডেন্ট ফান্ডে আপনার নির্ধারিত মাসিক চাঁদা প্রদান করে যেতে হবে।
গ্রাচ্যুইটি
এটি একটি এককালীন আর্থিক সুবিধা যা চাকরি ছেড়ে দিলে বা চাকরি থেকে অবসর নিলে পাওয়া যায়। এটা অনেকটা পশ্চিমা বিশ্বের রিডানডেন্সি পলিসির মত।
তবে প্রভিডেন্ট ফান্ডের মত এক্ষেত্রে কাউকে নিজের পকেট থেকে কোন টাকা জমা রাখতে হয় না। গ্রাচ্যুইটির পুরো অর্থই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দেয়া হয়।
এখন আপনি কি পরিমাণ অর্থ গ্রাচ্যুটি হিসেবে পাবেন, সেটা নির্ভর করে আপনি কোন প্রতিষ্ঠানে কতদিন চাকরি করেছেন তার উপর।
যেসব প্রতিষ্ঠান তার কর্মীদের গ্রাচ্যুইটি সুবিধা দেয়, তারা সাধারণত প্রতিবছর চাকরি করার জন্য একজন কর্মীকে তার বিদায়বেলায় ৩০ দিনের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করে।
এই ৩০ দিনের বেতন হিসেব করা হয়, কর্মীর সর্বশেষ মাসের বেতনকে ভিত্তি ধরে।
অর্থাৎ আপনি চাকরিতে যোগদানের সময় যদি আপনার বেতন কমও থাকে, কিন্তু পরবর্তীতে বেড়ে যায়, তাহলেও আপনি ক্ষতি গ্রস্থ হবেন না, কেননা, আপনার গ্রাচ্যুইটি হিসেব হবে, আপনার সর্বশেষ মাসের বেতনের হিসেবে।
এখন ধরুন আপনি কোন প্রতিষ্ঠানে ৫ বছর চাকরি করেছেন। আর সেখানে আপনার সর্বশেষ মাসের বেতন ১ লাখ টাকা। তাহলে ৫ বছর চাকরি করার জন্য আপনার গ্রাচ্যুইটি কত হবে বলুন দেখি?
অনেকেই হয়ত বলবেন ৫ লাখ টাকা। কেননা ৫বছরের জন্য ৫টি ৩০ দিন বা ১ মাসের বেতন তো ৫ লাখই হয়।
কিন্তু না, আপনি আসলে পাবেন সারে ৭ লাখ টাকা। কিভাবে? দেখুন তাহলে…
গ্রাচ্যুইটি আইন অনুযায়ী, প্রতি বছরের জন্য আপনি পাবেন সর্বশেষ মাসের হিসেব অনুযায়ী ৩০ দিনের সমপরিমাণ অর্থ, ১ মাসের বেতন নয়। ব্যাপারটি ভাল করে বুঝুন।
আপনি প্রতিমাসে যে বেতন পান, সেটা কিন্তু ৩০ দিন কাজের জন্য নয়। বরং গড়ে ২০ দিন কাজের জন্য। তাহলে মাসে আপনার ১ লাখ টাকা মূল বেতন হলে, আপনার ১ দিনের বেতন হয় ৫ হাজার টাকা।
তাহলে আপনার ৩০ দিনের বেতন দাড়ায় ১৫০ হাজার বা দেড় লাখ টাকা।
এখন তাইলে ৫ বছর চাকরি করার জন্য আপনি পাবেন ৫ X ১৫০ হাজার = ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
আশা করি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন আর নিজের গ্রাচ্যুইটির হিসেব এখন নিজেই বের করতে পারবেন।
তবে এখানে বলে রাখা ভাল যে, অনেক প্রতিষ্ঠানই ৩০ দিনের বেতন বলতে ১ মাসের বেতনই বোঝে এবং সেভাবেই কর্মীদের গ্রাচ্যুইটি সেটেল করে। তাই প্রকৃত হিসাবের পদ্ধতি জানতে একজন বিশেষজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কেননা এই ব্লগ কোন আইনগত পরামর্শ দেয় না।
এখন কেউ যদি তার প্রাপ্য গ্রাচুইটির অর্থের পরিমাণ সরাসরি দেড়গুণ বাড়াতে চায়, তাহলে তাকে কোন প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে একটানা ১০ বছর চাকরি করতে হবে।
অর্থাৎ আপনি যদি ১০ বছর বা তারচেয়েও বেশিদিন কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, তাহলে প্রতিবছর চাকরি করার জন্য আপনার গ্রাচ্যুইটি হবে সর্বশেষ মাসের ভিত্তিতে ৪৫ দিনের বেতনের সমান।
তারমানে ৯ বছর পর্যন্ত চাকরি করলে আপনি পাবেন ৩০ দিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ আর ১০ বছর বা তার বেশিদিন কাজ করলে পাবেন ৪৫ দিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ।
যাইহোক, আজ এ পর্যন্তই। গ্রাচ্যুইটি এবং প্রভিডেন্ট ফান্ড সম্পর্কে আপনার যদি আরও কিছু জানা থাকে তাহলে তা আমদের কমেন্ট করে জানান।
Thanks a lot.
উত্তরমুছুনআপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
মুছুনপ্রভিডেন্ট ফাণ্ড কি বাংলাদেশ সরকারের আইন দ্বারা সুরক্ষিত? নাকি কোন প্রতিষ্ঠান চাইলেই তার কর্মীদের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সময় প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বঞ্চিত করতে পারে?
উত্তরমুছুনঅবশ্যই সুরক্ষিত। এ সম্পর্কিত আইন আছে, আবার শ্রম আইনেও এ নিয়ে কথা বলা আছে।
মুছুনআমি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৭ বছর সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছি। এখন যদি আম চাকুরী থেকে অবসর নিতে চাই, তাহলে কি আমি গ্রাচুইটি পাব,,,?
উত্তরমুছুনপাওয়ার কথা। ধন্যবাদ।
মুছুনগ্র্যাচুয়িটি ফান্ড ট্রাষ্ট এর অর্জিত সুদ কে ভোগ করবে?
উত্তরমুছুনগ্রাচ্যুইটি যেহেতু সম্পূর্ণ ভাবে নিয়োগকর্তা প্রদান করে, তাই এর অর্জিত সুদও নিয়োগকর্তা ব্যবহার করতে পারে। ধন্যবাদ।
মুছুনকোনো প্রতিষ্ঠানে গ্রাজুইটি পলিসি না থাকলে কি হবে?
উত্তরমুছুনবেসরকরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সকল শিক্ষক ও কর্মচরী কি একই হারে টাকা জমা দিবে, না স্কেল অনুযায়ী টাকা জমা দিবে?
উত্তরমুছুনচাকুরি ছেড়ে দিলে কি প্রভিডেন্ট ফান্ড এর টাকা পাওয়া যায়?
উত্তরমুছুনprovident fund এর সূচনা কত সাল থেকে হয়?
উত্তরমুছুনশুভেচ্ছা নিরন্তর
উত্তরমুছুনকোম্পানীর চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে চাইলে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা পাওয়ার জন্য চাকুরি থেকে অব্যাহতি ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা চেয়ে একসাথে আবেদন করতে হবে?
উত্তরমুছুনপ্রভিডেন্টফান্ড এর জন্য জাতীয়পরিচয়পত্র এর পরিবর্তে জন্ম নিবন্ধন বা পাসপোর্ট দিলে হবে
উত্তরমুছুনআমি প্রভিডী ফান্ডের টাকা তুলে কি লোন কাটবো বেতন থেকে
উত্তরমুছুনঅসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে
উত্তরমুছুনচাকরিজীবীর বয়স ৫০:বছর পূর্ণ হলে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলে নিতে পারে, পরিশোধ করতে হয় না এ রকম শিথিল বিশেষ কোনো নীতিমালা আছে কি না?
উত্তরমুছুনগ্রাচ্যুইটি কি সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত?
উত্তরমুছুনপ্রতিটি লিমিটেড কোম্পানি কি সেটা দিতে বাধ্য নাকি তারা না দিলে কিছুই করার নেই?
প্রভিডেন্ট ফান্ড করার নীতিমালা আছে ?? থাকলে আমার দরকার । marufbellah@gmail.com
উত্তরমুছুনএমপিও বিহীন অস্থায়ী, খন্ডকালীন, চুক্তিভিত্তিক শিক্ষকগন বিধিমোতাবেক পিএপ ফান্ডের সুবিধা পাবেন কিনা।
উত্তরমুছুন