সবাই টাকা জমাতে চায়, তবে বাস্তবতা হল, সবার টাকা জমানোর ক্ষমতা কিন্তু সমান নয়। বেশি আয় করলেই যে বেশি সঞ্চয় করতে পারবেন, বিষয়টা মোটেই তেমন নয়। সেকারণে দেখা যায়, অনেকেই অল্প আয় করেও অনেক টাকা জমিয়ে ফেলে, আবার অনেকে প্রচুর আয় করেও এক পয়সাও জমাতে পারে না!
তাই সঞ্চয়ের জন্য সবার আগে জানতে হবে, আপনার আসলে টাকা জমানোর প্রকৃত ক্ষমতা কতটুকু? আর এটা জানার জন্য আমরা ব্যবহার করব শতাধিক বছরের পুরনো জাপানি পদ্ধতি, যার নাম 'কাকিবো' (জাপানি ভাষার উচ্চারণ ভিন্ন হতে পারে)।
এই জাপানি পদ্ধতিতে আপনি মাত্র ৪টি সহজ প্রশ্নের উত্তর দিয়েই যাচাই করতে পারবেন, আপনার আসলে সঞ্চয়ের ক্ষমতা কতটুকু। শুধু তাই নয়, কাকিবো আপনার সঞ্চয়রে সামর্থ্য কিভাবে বাড়িয়ে তোলা যায়, সে পদ্ধতিও বাতলে দিবে।
কাকিবো পদ্ধতির জন্ম ১৯০৪ সালে, জাপানে। পারসোনাল ফিন্যান্স বা ব্যক্তিগত বাজেট ম্যানেজম্যান্টের জন্য এইপদ্ধতিটি আবিষ্কার করেন, জাপানি নারী সাংবাদিক হানি মটোকো।
অনেকেই কাকিবোকে টাকা জমানোর একটি উপায় বলে মনে করেন, যা আসলে সঠিক নয়। সত্য কথা হল, কাকিবো আসলে টাকা জমানোর কোন পদ্ধতি নয়, এটা হল, আপনার টাকা জমানোর প্রকৃত ক্ষমতা বের করার উপায় এবং টাকা জমানোর সামর্থ্য বৃদ্ধির একটি ফর্মুলা।
কাকিবো পদ্ধতিতে সফল হওয়ার জন্য আপনাকে ৩টি সহজ শর্ত মেনে চলতে হবে। এগুলো ঠিকমত মানতে পারলে আশা করা যায়, কাকিবো আপনার উপকারে আসবে। এই শর্ত গুলো হল,
১. কাকিবোতে ৪টি প্রশ্নের সাথে ৪ ধাপের একটি বাজেট প্লানারও সংযুক্ত আছে। তাই প্রশ্ন গুলোর উত্তর দেয়ার পাশাপাশি আপনাকে বাজেট প্লানারটিও মেনে চলতে হবে।
২. এ পদ্ধতির চর্চা আপনাকে হাতে কলমে করতে হবে, কোন রকম প্রযুক্তি বা ডিজিটাল ডিভাইসের সাহায্য নেয়া যাবে না। এটার কারণ হল, আপনি যখন কোন কিছু নিজের হাতে লিখবেন, তখন তা আপনার ব্রেনের সাথে এটাচড হয়ে যাবে, ডিজিটালি যেটা সম্ভব নয়। আর যে কাজে আপনার ব্রেন সম্পৃক্ত হবে না, সে কাজে আপনার সফল হওয়ার চান্স প্রায় নেই বললেই চলে।
৩. আর শেষ শর্তটি হচ্ছে, কাকিবোতে আপনার আয় ব্যয় সম্পর্কিত কোন তথ্য লুকোনো যাবে না। অর্থাৎ আপনাকে আপনার আয় ব্যয় সম্পর্কে শতভাগ সঠিক এবং পূর্ণাঙ্গ তথ্য নিয়ে কাজ করতে হবে।
চলুন তাহলে এবারে জেনে নেই, কিভাবে কাকিবো পদ্ধতি আপনি কাজে লাগাবেন, সেই উপায়।
প্রথম প্রশ্নঃ আপনার কাছে এখন কত টাকা আছে?
কাকিবো পদ্ধতি চর্চার শুরুতেই আপনাকে যে প্রশ্নটির উত্তর দিতে হবে সেটি হল, আপনার কাছে এখন কত টাকা আছে। এখানে এখন বলতে বুঝানো হয়েছে, চলতি মাস। অর্থাৎ চলতি মাসে আপনার টোটাল ইনকাম কত টাকা?
এই ইনকাম মানে শুধু মাসের শুরুতে আপনার হতে থাকা টাকা নয়, বরং পুরো মাস জুড়ে আপনার হতে মোট কত টাকা আসবে সেটা হিসাব করতে হবে।
কাকবোর সাথে যে বাজেট প্লানারটি আপনাকে মেনে চলতে হবে, সেখানকার ৪টি ধাপের প্রথমটি হচ্ছে 'ইনকাম'। তাই ইনকামের ঘরে আপনি লিখে ফেলুন, আপনার মোট মাসিক ইনকাম।
মোট মাসিক ইনকাম হিসাবের জন্য, মাসের শুরুতেই আপনি যে সমস্ত আয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত, শুধু সেগুলোই লিখে ফেলবেন। হঠাৎকরে মাসের পরবর্তী সময়ে কোন আয় চলে আসলে, তখনই কেবল সেটা লিখবেন।
হিসাবের সুবিধার জন্য ধরে নিলাম, আপনার মাসিক বেতন ১ লাখ টাকা এবং এর বাইরে আপনার আর কোন আয় নেই, এবং হঠাৎ আয়ের কোন সম্ভাবনাও নেই।
সুতরাং আপনি আপনার কাকিবো বাজেট প্লানারের ইনকামের ঘরে লিখে ফেলুন, চলতি মাসের মোট আয় ১ লাখ টাকা।
দ্বিতীয় প্রশ্নঃ আপনি মাসে কত টাকা জমাতে চান?
কাকিবোর দ্বিতীয় প্রশ্নটি একেবারেই সোজা-সাপ্টা, আর এর উত্তরটিও খুবই সহজ। প্রশ্নটি হচ্ছে, আপনি মাসে কত টাকা জমাতে চান? আর উত্তরটি আপনি আপনার চাহিদা মত দিতে পারেন।
তবে মনে রাখবেন, এখানে আপনি উত্তর হিসেবে যত বড় অংকের কথা বলবেন, আপনাকে তত কঠোর ভাবেই কাকিবোর ধাপ গুলি মেনে চলতে হবে।
আবারো সহজে হিসাবের জন্য ধরে নিচ্ছি, আপনার মাসিক সঞ্চয় লক্ষ্য ১০ হাজার টাকা, কেননা একজন মানুষের জন্য তার আয়ের নূন্যতম ১০% সঞ্চয় থাকাটা আদর্শ।
তো এবার আপনার কাকিবো বাজেট প্লানারের টার্গেট বা লক্ষ্যের ঘরে লিখে ফেলুন ১০ হাজার টাকা।
তৃতীয় প্রশ্নঃ আপনি মাসে কত টাকা খরচ করেন?
কাকিবোর এই প্রশ্নটির উত্তর অনেকের কাছেই জটিল হয়ে উঠতে পারে। কেননা, মানুষের খরচের কোন শেষ নেই। তাছাড়া একেক মাসের খরচ একেক রকম। তাই মাসে আপনি কত টাকা খরচ করেন এই প্রশ্নের জটিল উত্তরকে সহজ করার জন্য কাকিবো বাজেট প্লানারে রয়েছে সুন্দর একটি ব্যবস্থা।
কাকিবো অনুযায়ী, আপনার সমস্ত খরচ গুলোকে মাসের শুরুতেই বাজেট প্লানারের তৃতীয় ধাপে মোট দুটি মূল ক্যাটেগরিতে সাজাতে হবে। এর প্রথম ক্যাটেগরিটি হচ্ছে, আবশ্যিক খরচ, যেগুলো ছাড়া আপনি চলতে পারবেন না এবং যে খরচ গুলো আপনাকে করতেই হবে। যেমন বাড়ি ভাড়া, বাচ্চাদের স্কুলের বেতন, ইউটিলিটি বিল, খাবার খরচ ইত্যাদি।
এই ক্যাটেগরির প্রতিটি খাতের জন্য আপনার ব্যয় বরাদ্দ কাকিবো বাজেট প্লানারে লিখে ফেলুন। ধরে নিলাম, আপনার মাসিক আবশ্যিক খরচ ৬০ হাজার টাকা।
এবার আসুন দ্বিতীয় ক্যাটেগরিতে, যেটি হচ্ছে আপনার জীবন-যাপন ব্যয়। এই ক্যাটেগরিতে কমপক্ষে ৪টি ধাপ থাকতে হবে, তবে আপনি চাইলে ধাপের সংখ্যা প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়াতেও পারেন।
প্রথম ধাপটি হচ্ছে, লিভিং স্ট্যান্ডার্ড খরচ, যেখানে রয়েছে, আপনার লন্ড্রি বিল, যাতায়াত খরচ, আপনার পোশাকের খরচ, চিকিৎসা খরচ ইত্যাদি।
দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে, শিক্ষা এবং সংস্কৃতির খরচ। এ খাতে রয়েছে, আপনার বই পত্র কেনা, শিক্ষণীয় জায়গায় ভ্রমণ, বিভিন্ন প্রশিক্ষন গ্রহণের খরচ, সামাজিকতা মেনে চলার খরচ, যেমন কারও বিয়ের দাওয়াতে যাওয়া ইত্যাদি।
তৃতীয় ধাপ হচ্ছে, বিনোদনের খরচ। এখাতে রয়েছে আপনার রেস্তরায় খাওয়ার বিল, সিনেমা দেখার বিল, নেটফ্লিক্সের চার্জ, খেলা দেখার টিকিটের দাম ইত্যাদি।
আর চতুর্থ ধাপটি হচ্ছে, অন্যান্য। অর্থাৎ উপরের ধাপ গুলোতে যে খারচ গুলো ফেলা যাচ্ছে না, সেগুলো এই ধাপে যোগ করতে হবে। যেমন, খুব বেশি প্রয়োজন না থাকলেও লেটেস্ট মডেলের মোবাইল কেনা, বন্ধু বা কলিগদের দেখানর জন্য নতুন নতুন ফ্যাশেনবল ড্রেস কেনা, দামি ঘড়ি, জুতা, বেল্ট কেনা ইত্যাদি।
ধরে নিলাম, উপরের দ্বিতীয় ক্যাটেগরির চারটি ধাপ মিলিয়ে আপনার চলতি মাসে মোট খরচ হওয়ার কথা ৫০ হাজার টাকা।
আপনি যেহেতু মাসের শুরুতেই কাকিবো বাজেট প্লানার নিয়ে বসবেন, তাই এই পর্যায়ে এসে কাকিবোর মাধ্যমে আপনি চলতি মাসে আপনার নিজের আয় এবং ব্যয়ের একটি পরিষ্কার চিত্র দেখতে পাবেন। অর্থাৎ কোন টাকা বাস্তবে খরচ হওয়ার আগেই আপনি জেনে যাবেন, কোথায় কোথায় আপনার টাকা কি পরিমাণে খরচ হতে চলেছে।
আর এটাই হচ্ছে কাকিবোর শক্তি। কেননা খেয়াল করে দেখুন, কাকিবো তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরে আপনার খরচের হিসাব জানার আগেই, দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে আপনি কি পরিমাণ টাকা সঞ্চয় করতে চান, তা জেনে নিয়েছে।
তো আসুন এবারে দেখি, আপনার চলতি মাসের কল্পিত বাজেটটির অবস্থা কি দাঁড়াল?
চলতি মাসে আপনার আয় ছিল, ১ লাখ টাকা। আর আবশ্যিক ব্যয়, মানে খাবার, বাড়ি ভাড়া, স্কুলের বেতন বাবদ ব্যয় ছিল ৬০ হাজার টাকা আর এর সাথে জীবন-যাপনের জনিত আরও ব্যয় ছিল ৫০ হাজার টাকা।
তাহলে আপনি চলতি মাসের মোট খরচ করতে যাচ্ছেন, ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। যা কিনা আপনার আয়ের চেয়েও ১০ হাজার টাকা বেশি!
অন্যদিকে আপনার চলতি মাসে সঞ্চয়ের লক্ষ্য ছিল ১০ হাজার টাকা।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সঞ্চয় তো দুরের কথা, আপনার খরচের পরিকল্পনা অনুযায়ী আপনি যদি চলতি মাসটি পার করতে চান, তাহলে আপনাকে উল্টো আরও ১০ হাজার টাকা ঋণ করতে হবে।
অর্থাৎ কাকিবো আপনাকে জানিয়ে দিল, চলতি মাসে আপনার সঞ্চয়ের কোন ক্ষমতাই নেই।
লাখ টাকা আয় করেও কেন আপনি একটি পয়সাও সঞ্চয়ের ক্ষমতা রাখেন না, কাকিবো তা আপানাকে এবার চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে!
আমাদের অনেকের জীবনে বাস্তবেও এমন অবস্থা হয়। কিন্তু এরকম অবস্থায় যেন আপনাকে পরতে না হয়, সেজন্য কাকিবো আপনাকে সাহায্য করতে পারে, যদি আপনি এর চতুর্থ প্রশ্নটির জবাব দেন।
চতুর্থ প্রশ্নঃ কিভাবে ব্যক্তিগত আর্থিক ব্যবস্থাপনার আরও উন্নতি করা যায়?
কাকিবোর শেষ এই প্রশ্নটিই আপনাকে বাঁচাতে পারে আর আপনার সঞ্চয়ের ক্ষমতাও বাড়িয়ে তুলতে পারে। এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য, আপনাকে আবার তৃতীয় ধাপে ফিরে যেতে হবে, যেখানে আপনি আপনার ব্যায়ের খাত গুলো লিখেছিলেন।
প্রথম ক্যাটেগরির খাত গুলোতে আপনি হাত দিতে পারবেন না, কেননা এগুলো আবশ্যিক খরচ।
তাই আপনাকে দ্বিতীয় ক্যাটেগরির খাত গুলোকে ভালভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হবে যে, কোন খরচটা আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। কোন খরচটা আপনি না করলেও আপনার তেমন কোন ক্ষতি হবে না। আপনার কি লেটেস্ট মডেলের ফোনটা কিনতেই হবে? দ্বিতীয়বার ভেবে দেখুন।
এভাবে আপনি জীবন যাপনের খরচ গুলো থেকে কাট-ছাট করে আপনার ভবিষ্যৎ খরচ কমিয়ে আনতে পারবেন আর আপনার সঞ্চয়ের লক্ষ্যও পূরণ করতে পারবেন।
এমনি করে কয়েক মাস প্রাক্টিস করার পর আপনি কাকিবোর প্রকৃত শক্তি বুঝতে পারবেন আর সেই সাথে আপনার সঞ্চয়ও বাড়তে থাকবে।
কয়েকমাস পর আপনি চাইলে প্রতিমাসে আপনার সঞ্চয়ের লক্ষ্যও বাড়িয়ে নিতে পারেন, আর সে অনুযায়ী আপনার কাকিবো চর্চা চালিয়ে যেতে পারেন।
আশাকরি এই কাকিবো পদ্ধতিটি আপনাদের টাকা সঞ্চয়ের ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মতামত জানান।