ভালো আয় এবং প্রতিবছর নিয়মিত বেতন বাড়ার পরও চাকরিজীবীদের অনেকেই টাকা পয়সার টানাটানিতে থাকে সবসময়। এক অদৃশ্য গরীব হয়ে জীবন যাপন করে সারা জীবন।
কিন্তু কেন এমন হয়? চাকরি করেও লোকে কেন অভাবে থাকে? বছর বছর বেতন বৃদ্ধি কি তাহলে কোন কাজেই লাগে না?
বাস্তবতা হচ্ছে, বানরের তৈলাক্ত বাঁশে ওঠার অংকের মতই, বেতন যতই বাড়ুক না কেন অনেকেরই গরিবানা যায় না, অভাবে থেকেই যায়।
প্রতিবার ভাবে, এবার বেতন বাড়লে হয়ত সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু শেষে এসে দেখা যায়, যে লাউ, সেই কদু! বেতন বাড়লেও জীবনের কোন উন্নতি হয় না, অনেকে উল্টো আরও গরীব হয়ে যায়, অভাব পিছু ছাড়ে না কিছুতেই।
বানরের তৈলাক্ত বাঁশে ওঠার অংকের মত, শত চেষ্টা করেও বানরটি যেমন সহজে বাঁশের ডগায় চড়তে পারে না, তেমনি প্রতি বছর বেতন বাড়লেও আপনার পকেটের অবস্থা যা ছিল তাই থেকে যায়।
তারমানে এই না যে, আপনি বেহিসেবি খরচ করেন। বরং আগের চেয়ে অনেক খরচ কমিয়ে ফেলেছেন, কিন্তু তাতেও অবস্থার কোন পরিবর্তন নেই। উল্টো মাঝে মাঝে আগের সঞ্চয় ভেঙ্গেও দৈনন্দিন খরচ চালিয়ে নিতে হচ্ছে।
কিন্তু কেন এমন হয়? সমস্যাটা আসলে কোথায়? আর আপনি কি শুধু একাই এই অবস্থার মধ্যে আছেন?
কেন এমন ঘটে তার কারণ মূলত দুটি। একটি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়, আর অন্যটি সাধারণ মানুষের নিয়ন্ত্রনের বাইরে।
এ বিষয় গুলো নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে আজকের এই পোস্টে। আশাকরি পুরোটা পড়লে অনেকেরই উপকার হবে।
কেন এমন হয়?
প্রতিবছর নিয়মিত বেতন বাড়ার পরও কেন আপনি গরিবই থেকে যান, তার মুল কারন আসলে দুটি।
এর মধ্যে একটিকে আপনি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রন করতে পারেন, আর অন্যটি পুরপুরিভাবেই আপনার নিয়ন্ত্রনের বাইরে। আপনি শুধু এর খেসারত দেন সার্বক্ষণিক।
মূলত দ্বিতীয় কারণটির জন্যই আপনি গরীব আর বেতন যতই বাড়ুক না কেন শেষ পর্যন্ত আপনি গরিবই থেকে যান!
যাইহোক, এবারে কারণ দুটিকে একে একে বিশ্লেষণ করি।
উচ্চ শিক্ষিত হয়ে ভালো বেতনের চাকরি করার পরও কেন আপনি গরীব, তার প্রথম কারণটি হল, আপনি নিজে!
হ্যা, আপনি নিজেই নিজের গরিবানা অবস্থার জন্য দায়ী।
ব্যাক্তিগত আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দক্ষ না হলে যতই উপার্জন করুন না কেন, শেষ পর্যন্ত আপনি গরীবই থেকে যাবেন।
অনেকেই টাকা আয় করে ঠিকই, কিন্তু খরচের ক্ষেত্রে কোন রকম আর্থিক ব্যবস্থাপনা করে না।
আর্থিক ব্যবস্থাপনা হচ্ছে এমন একটি বিষয়, যা আপনাকে আপনার প্রতিটা খরচের খাতের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখতে সাহায্য করবে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বেশিরভাগ মানুষেরই ব্যক্তি জীবনে কোন রকম আর্থিক ব্যবস্থাপনা নেই।
একারণে, অনেকেই ব্যয় করে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনের ভিত্তিতে। আয়ের হিসেব থাকলেও এই সমস্ত মানুষের ব্যায়ের কোন হিসাব নেই।
যে কারনে, যখন যে প্রয়োজন সামনে আসে তখন সেখানেই টাকা খরচ করতে হয়। ফলে মাসের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে এসে পকেটে আর কোন টাকাই থাকে না।
এরমধ্যে আবার বড় ধরনের কোন বিপদ বা আসুখ-বিসুখের ঘটনা ঘটলে ঋণ করা ছাড়া তখন আর কোন উপায় থাকে না।
আবার অনেকে আছেন, ভবিষ্যতে বেতন বাড়বে বলে এখন থেকেই খরচ করা শুরু করে দেয়, না হয় খরচের খাত তৈরি করে রাখে।
এরফলে বেতন যখন বাড়ে তখন আর তার সুফল সেভাবে পাওয়া যায় না।
আর বেতনভুগি মানুষের জন্য একবার ঋণের জালে আটকা পড়লে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা অনেক কঠিন।
কেননা, দিনে দিনে অন্যান্য প্রয়োজনগুলোর পরিমাণ বাড়তেই থাকে আর ঋণ থাকলে তা শোধ করা আরও কঠিন হয়ে ওঠে।
কিন্তু আপনি চাইলেই এই সমস্যাটিকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। কেননা এই পুরো বিষয়টিই আপনার কন্ট্রোলে রয়েছে।
একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, আপনার খরচ গুলো আসলে দুই ভাগে বিভক্ত। কিছু খরচ আছে, যেগুলো প্রতিমাসে নির্দিষ্ট। এই যেমন আপনার বাড়ি ভাড়া, বাচ্চাদের স্কুলের ফি, পানি বিল, গ্যাস বিল ইত্যাদি।
এমনকি মোবাইল এবং বিদ্যুৎ বিলও প্রতিমাসে আপনার কেমন আসে তার একটা ধারণা আপনার আছে।
সুতরাং যে খরচগুলো ফিক্সড, সেগুলো নিয়ে আপনার তেমন কোন চিন্তা নাই। কেননা, আপনি জানেন এই ব্যায়গুলো আপনাকে করতেই হবে আর এই পরিমাণ টাকা আপনাকে প্রতিমাসে উপার্জন করতেই হবে!
কিন্তু সমস্যা হয়, যে খরচগুলো ফিক্সড নয়, সেগুলো নিয়ে। এগুলোকে বলে ভেরিয়েবল কষ্ট বা পরিবর্তনশীল খরচ। এই যেমন ধরেন আপনার বাজার খরচ, হাত খরচ, যাতায়াত, আপ্যায়ন, সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য উপহার সামগ্রী কেনা, আসুখ-বিসুখ এমন কি আত্মীয়-স্বজনের বিপদ-আপদ ইত্যাদি।
এর মধ্যে বাজার খরচের জন্য আপনার স্বাভাবিক একটা প্রস্তুতি থাকলেও কেনার সময় দেখা যায় এমন অনেক কিছুই কেনা হয়ে যায়, যেগুলো আসলে না কিনলেও চলত। আর বাড়তি বেতনের টাকা পকেটে থাকলে তো কোন কথাই নেই!
কিন্তু অন্যান্য খরচগুলোর জন্য কারও তেমন কোন প্রস্তুতি থাকে না। বেশিরভাগ মানুষই এই খরচ গুলো করে থাকে যখন যেটা সামনে আসে, তার ভিত্তিতে।
ফলে মাসের শুরুর দিকে কোন একটি খাতে একটু বেশি খরচ হয়ে গেলেই পরের দিকে অন্য খাত গুলোর জন্য আর কোন বরাদ্দ থাকে না।
আর ঠিক তখনি আপনার গরিবানা হালটা প্রকাশ হয়ে পড়ে।
কিন্তু আপনি যদি আপনার ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক জীবনকে ভালভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারেন, তাহলে দেখবেন খুব সহজেই ভেরিয়েবল বা পরিবর্তনশীল খরচ গুলোকে ফিক্সড খরচে রূপান্তর করা যায়।
সেটা করার জন্য প্রথমেই সমস্ত অপ্রয়োজনীয় খরচ বাদ দিন। এরপর আপনার প্রতিটা ভেরিয়েবল খরচের জন্য একটা করে ফিক্সড বাজেট নির্ধারণ করুন।
বাজেট নির্ধারণের সময় চলতি মাসের সেই খাতের প্রকৃত খরচের চেয়ে ৫ শতাংশ বাড়িয়ে নির্ধারণ করুন। তাহলে, সময়ের সাথে খরচের সামান্য হেরফেরের জন্য আপনার আর পরে বাজেট ফেইল হবে না।
প্রতিটা খাতের বাজেট হয়ে গেলে আরেকটি খাতের জন্য একটি অতিরিক্ত বাজেট বানাতে হবে।
এই খাতের নাম দিন ‘ব্যাকআপ’। অর্থাৎ এই খাতের টাকা আপনি কেবল তখনই খরচ করবেন, যখন অন্য কোন বাজেট হঠাত করে ফেল করবে। আর কাজে না লাগলে এটা আপনার সঞ্চয় হিসেবে থেকে যাবে।
আপনি যদি এভাবে সব খাতের বাজেট করেন, তাহলে আপনার সব খরচই একটা ফিক্সড খরচে রুপ নেবে আর আপনার হিসেব রাখতে সুবিধা হবে।
আপনি জানবেন, মাসে আপনার মিনিমাম কত টাকা লাগবে আর ঠিক কত টাকা হলে আপনি ভালভাবে চলতে পারবেন।
এখন আপনি আপনার খরচ অনুযায়ী আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারেন অথবা আপনার আয় অনুযায়ী খরচের ফিক্সড খাত তৈরি করতে পারেন।
এতে করে ভবিষ্যতে বেতন বাড়লে, তা আর আপনার সাথে সাথে খরচ হয়ে যাওয়ার রিস্ক থাকবে না।
আপনি কিছুটা হলেও আর্থিকভাবে স্বস্তি পাবেন।
এবার আসা যাক দ্বিতীয় কারণটিতে, যেটা আপনার নিয়ন্ত্রনের বাইরে।
এটা একটা ক্ষুধার্ত দানবের মত আর এই দানবের খাবারের যোগান দিতে আপনি বাধ্য!
এই দানব যত বড় হয়, এর ক্ষুধা তত বাড়তে থাকে আর আপনি ততই গরীব হতে থাকেন! এই দানব আপনার সৃষ্টি না হয়ে থাকলেও এর খেসারত দিতে হয় আপনাকে, আমাকে সবাইকে।
এই দানবের নাম হচ্ছে ইনফ্লেশন বা মুদ্রাস্ফীতি ।
যারা অর্থনীতির কঠিন শব্দ বুঝতে পারেন না, তাদের জন্য সহজ করে বললে বলা যায় যে, মুদ্রাস্ফিতি হচ্ছে সেই জিনিস যার কারনে মূল্যস্ফীতি ঘটে।
অর্থাৎ আপনি যখন দেখেন কোন কারন ছাড়াই কোন দ্রব্য বা সেবার দাম বেড়ে গেছে, তখন বুঝবেন, সেটা হয়েছে মুদ্রাস্ফিতির কারণে।
এই ইনফ্লেশনই আপনার খরচের পরিমাণ দিনে দিনে বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা আপনার নিয়ন্ত্রনের বাইরে।
ইনফ্লেশন কেন হয়, সেটা আজকে নয়, বরং অন্য কোন দিন আলোচনা করব। তবে কিভাবে ইনফ্লেশনের চড়া মুল্য আমাদের সবাইকে দিতে হচ্ছে, সেটা আজকে তুলে ধরব।
ধরুন, কোন এক দেশের সরকার ঘোষণা করল যে, সেদেশে এবছর মুদ্রাস্ফিতি বা ইনফ্লেশনের হার ১০ শতাংশ।
এরমানে হচ্ছে, সেদেশে এবছর সবকিছুর দাম গড়ে ১০ শতাংশ বেড়েছে। এটা শুধু দ্রব্য এবং সেবার গড় মুল্য বৃদ্ধি। এর বাইরে যদি সরকার আবার ইনকাম ট্যাক্স বাড়ায় তাহলে সেটা এর সাথে যোগ হবে।
এখন কথা হচ্ছে, গতবছর যে জিনিস কিনতে আপনি ১০০ টাকা খরচ করেছেন, ইনফ্লেশনের জন্য এবছর সেই একই জিনিস কিনতে আপনাকে খরচ করতে হচ্ছে ১১০ টাকা।
অর্থাৎ এবছর আপনি যদি অর্থনৈতিক ভাবে শুধু গত বছরের সমান হয়েই থাকতে চান, তাহলেও আপনাকে গত বছরের চেয়ে অন্তত ১০ শতাংশ আয় বাড়াতে হবে।
কিন্তু আপনার বেতন যদি এবছর ১০ শতাংশ না বাড়ে, তাহলে আপনি কিন্তু গতবছরের চেয়ে গরীব হয়ে যাবেন।
ধরুন, এবছর আপনার বেতন বেড়েছে ৫ শতাংশ আর মুদ্রাস্ফিতির হার ১০ শতাংশ। তারমানে আপনি বেতন বাড়া সত্ত্বেও এবছর গত বছরের চেয়ে ৫ শতাংশ গরীব হয়ে গেছেন।
কিন্তু এই হিসবের মধ্যে একটা ফাঁক আছে। আসুন এবারে দেখি সেটা কি?
ধরুন, ইনফ্লেশনের হার ১০ শতাংশ আর আপনার বেতনও বাড়ল ১০ শতাংশ। কিন্তু তারপরও আপনার অবস্থা দিন দিন গরিবানার দিকে যাচ্ছে, কিন্তু কেন?
এর উত্তর লুকিয়ে আছে প্রথম কারণটির মধ্যে, যেটা আপনার কন্ট্রোলে থাকে।
আসলে সরকার যে মুদ্রাস্ফিতির হার ঘোষণা করে, সেটা হল সারা দেশের সমস্টিক অর্থনীতির গড় হার। আপনি ব্যাক্তি জীবনে যে খাত গুলোতে খরচ করেন শুধু সেগুলোর হার নয়।
দেশের গড় মুদ্রাস্ফিতি ১০ শতাংশ হলেও আপনার জীবনের মুদ্রাস্ফিতি হয়ত এবছর ২৫ শতাংশ। কিন্তু আপনার বেতন বেড়েছে দেশের গড় হারের সাথে সমন্বয় করে ।
সুতরাং আপনার বেতন ১০ শতাংশ বাড়লেও আপনি আসলে প্রকৃত অর্থে এবছর গতবছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি গরীব হয়ে গেছেন।
আর সেকারনেই এবছর আপনাকে হয়ত সঞ্চয় ভেংগে খরচ করতে হবে, খরচের খাতে নতুন কোন কিছু যোগ না হওয়ার পরও।
অর্থাৎ আপনার বেতনের বাড়তি অর্থ চলে গেছে মুদ্রাস্ফিতি নামক সেই দানবটার পেটে। আর এ থেকে আপনার কোন মুক্তি নেই।
আর এভাবেই চাকরিজীবীরা প্রতিনিয়ত অভাবের গ্যাঁড়াকলে পিষ্ট হয়ে চলেছে অনন্তকাল ধরে। অভাবের এই চক্র থেকে বের হতে হলে, আপনাকে অবশ্যই মুদ্রাস্ফীতির চেয়ে বেশি হারে প্রতিবছর আয় বাড়াতে হবে এবং নিজের খরচের খাতে লাগাম টানতে হবে। এছাড়া ার কোন উপায় নেই!
বিষয়টি ভালভাবে বুঝতে নিচের ভিডিওটি দেখে নিতে পারেন।
বি.দ্রঃ এ ধরনের তথ্যগুলি সময়ে সময়ে পরিবর্তন হয়ে থাকে। তাই বর্তমান সময়ের একচুয়াল তথ্যের সাথে পোস্টের তথ্যের পার্থক্য থাকতে পারে। ডিসক্লেইমার জানতে এবং পোস্ট ব্যবহারের আগে শর্তাবলী দেখে নিন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মতামত জানান।